কনস্তান্তিন কাভাফি আমার প্রিয় কবিদের একজন। তার কবিতার কারণে তো বটেই, তার পরিপূর্ণ কাব্যিক জীবনবোধটাই অনুকরণীয়। তিনি কখনো কবিতার বাধাঁই করা সাজানো গোছানো বই করেন নাই। মাত্র ১০ টা কবিতা নিয়ে একেকটা পুস্তিকা করতেন। এবং হাতে হাতে বিলি করতেন। যাদের তিনি কবিতার পাঠক মনে করতেন। তার এরকমই একটা পুস্তিকা হাতে পেয়েছিলেন তৎকালীন লণ্ডনের প্লুরাল পত্রিকার সম্পাদক কবি টি এস এলিয়ট। এলিয়ট পেয়েছিলেন মুলত আরেক কবিতা আবিস্কারক এজরা পাউণ্ডের হাতে। পরের দিনই এজরা পাউণ্ডকে এলিয়ট বলেছিলেন আমি এই দশটা কবিতার ভেতর গ্রীসের সমগ্র ইতিহাসের গতিকে অনুভব করেছি। পরের সংখ্যা প্লুরালে ছাপা হলো কাভাফিকে নিয়ে বিশেষ ক্রোড়পত্র। এরপর দ্রুত জগত জানতে পায় এই শক্তিমান কবিকে।
যাইহোক আমার মনে হয়েছে কবির সততার এটি একটি উদাহারণ আর সৎ সম্পাদকের উদাহারণও বটে।
কবি দুপুর মিত্রের ৪৪ কবিতা নামের এই সহজে বহনযোগ্য পুস্তিকাটি
( যদিও এটিকে বই হিসাবে তকমা দিয়েছেন কবি) হাতে পেয়ে কাভাফিকে মনে পড়ে যাওয়ার কারণ এটিও কবি কতৃক বিনামূল্যে প্রদত্ত, এটিও একটি পুস্তিকা, এবং স্পষ্টাক্ষরে লেখা আছে পুস্তিকাটির গায়ে এটি বিক্রয়ের জন্য নয়, এবং এটি কপিলেপ্টেট এবং………।
মুল কথা পুস্তিকাটির প্রচ্ছদ ভেতরের বয়ান মিলে পুস্তিকাটি পড়ার জন্য বাধ্য হলাম। পড়ে মনে হলো আমি ঠকি নাই। এই বইয়ের আরজ গুজার আমার দায়িত্বের অন্তভূর্ক্তি।
১ থেকে ৪৪ টি কবিতা যদিও সবই আলাদা কবিতা তবুও কবিতাগুলোর কোনো শিরোনাম নাই। শুধু নম্বর দিয়েই কবিতাগুলো চিহ্নিত।
প্রথমেই বলে রাখি আরোপিত বা জোর করে লেখা কবিতা পড়ার দায় পাঠককে কেউ দয় নাই যার জন্য আরোপিত কবিতা আমি পড়ি না। কবি দুপুর মিত্রের কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে এত আনন্দিত হবার কারণ হিসাবে পরে ভাবছি স্বতস্ফুর্ততা, শব্দের সাবলিল গ্রন্থনা, প্রাণবন্ত বলার ভঙ্গি, বিষয়ব্স্তু।
কবিতার জন্য বিষয়বস্তু খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। কারণ কবি সচেতনভাবে বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবেন বলে মনে হয় না। ভাবলেও একই বিষয়ব্স্তুর ভেতর তিনি সম্পুর্ণ কবিতাটি লেখার সময় পর্যন্ত থাকতে পারেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। বরং বিষয়বস্তুর আবহ নানা ধরনের বিষয়কে একই মাত্রায় প্রবাহিত করে।
নস্টালজিয়া, গ্রাম আর শহরের দূরত্ব ও সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক ঘঠনাবলি, শ্রেণী বৈষম্য, পুঁজিবাদি রাস্ট্রব্যবস্থাপনায় শিশুমনের অনুভুতি ইত্যাদি বিষয়গুলো অভূতপূর্বভাবে উঠে আসতে থাকে দুপুর মিত্রের কবিতায়।
শহরে হেলিকপ্টার উড়ে আসলে
কতলোক উপরে তাকায়
যেন কত দিন ধরে তাদের ইচ্ছে উড়ে বেড়াবার
কতদিন ধরে ইচ্ছে তাদের মুক্ত হবার
আমাদের গ্রামেও একদিন হেলিকপ্টার উড়েছিল
তখন অবশ্য কেউ উড়ে বেড়াবার কথা ভাবেনি
ভেবেছিল কিছু খাবার পড়ুক
হেলিকপ্টারের জানালা থেকে (৫. ৪৪ কবিতা)
এই কবিতাটির ভেতর গ্রাম আর শহরে বাসকৃত লোকজনদের স্বপ্ন, বাসনা আর বৈষম্য ধৃত। এ ধরণের অসাধারণ পরিপক্ষ কবিতায় পুস্তিকাটি সম্মৃদ্ধ। প্রত্যেকটি কবিতা নিয়েই দীর্ঘ আলোচনার অবকাশ ও আশা আছে। পরিশেষে কবি দুপুর মিত্রের যুদ্ধের প্রক্রিয়াটিকে সাধুবাদ জানাই। বইটির সততা সম্পর্কে আমি প্রশ্নহীন। বইটি বাংলা একাডেমীর লিটলম্যগ চত্বর বর্তমান লেখককুঞ্জে কবি দুপুর মিত্র কতৃক সহস্তে বিলিকৃত।
নিম্নোক্ত লেখাটি বইটির পেছনে লেখা আছে।
এ বইয়ের সমস্ত লেখা কপিলেফট। এ বইটির যে কোনো অংশ যে কেউ অবাণিজ্যিক ও অলাভজনক উদ্দেশ্যে মুল লেখক ও লেখাকে অবিকৃত রেখে লেখক ও প্রকাশকের অনুমতি ব্যতিরেকেই নকল এবং পরিবেশন করতে পারবেন। এছাড়া বইটি কেবল মাত্র ই-মেইলে লেখকের সাথে যোগাযোগ করে যে কেউ বিনামূল্যে সংগ্রহ করতে পারবেন। ই-মেইল ঠিকানা mitra_bibhuti@yahoo.com
পরিশেষে কবির সাথে আমিও একাত্ততা ঘোষণা করি
প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে মনে হয়
কেউ একজন আমাকে
ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছে
বিছানার চাদর থেকে
ময়লা ফেলার মতো
প্রতিদিন ঘুমুতে গেলে মনে হয়
এখানেই আমাকে ঘুমুতে হবে
বালিশে শ্বাসরোধ করে হলেও।
এই অপূর্ব কবি দুপুর মিত্রকে অভিনন্দন জানাই।